পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী যে কখনো মারা যায় না! অমর জেলিফিশের গল্প!

ভেবেছেন কি কখনও, যদি আপনি বয়সের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন, আর তখন শরীর নিজে থেকেই আবার ছোটবেলার রূপ ধরে নেয়? সবকিছু আবার নতুন করে শুরু হয়? যেন আপনার শরীরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক "টাইম মেশিন" - যা সময়কে পেছনে ফেরাতে পারে!

এই কথাটা যেন সায়েন্স ফিকশনের গল্পের মতো শোনায়, তাই না? অথচ বাস্তবে এমনই একটি প্রাণী রয়েছে পৃথিবীতে, যে প্রকৃতির এই অসম্ভব শক্তিকে বাস্তব করে তুলেছে। এটি আসলে একটি জেলিফিশ, যার নাম Turritopsis dohrnii, বিজ্ঞানীদের মতে এটি পৃথিবীর একমাত্র “অমর প্রাণী”।

Turritopsis dohrnii - একটি ক্ষুদ্র অথচ অদ্ভুত জীব

এই জেলিফিশটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৪-৫ মিলিমিটার, যেকোনো মানুষের নখের আগার সমান। স্বচ্ছ দেহ, ঘণ্টার মতো দেখতে, মাঝখানে লালচে কণিকা, আর তার নিচে ছড়িয়ে থাকা সুতোর মতো পা, যার সংখ্যা ৮০টিরও বেশি। দেখতে একেবারেই নিরীহ, অথচ এর ক্ষমতা এমন যে পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজও বিস্মিত।

এই জেলিফিশ প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৮০ সালে, ভূমধ্যসাগরের উপকূলে। কিন্তু তখন কেউ জানত না যে, এই ছোট্ট প্রাণীটির ভেতরে এমন এক শক্তি লুকিয়ে আছে যা মৃত্যুকেও ফাঁকি দিতে পারে।

জীবনচক্রে লুকিয়ে থাকা অমরত্বের রহস্য

সাধারণভাবে, প্রতিটি জেলিফিশের জীবনচক্রে তিনটি ধাপ থাকে:

১. লার্ভা (Planula): ডিম থেকে বের হওয়ার পর প্রথম এই অবস্থা।
২. পলিপ (Polyp): পাথর বা সামুদ্রিক বস্তুতে লেগে থাকা শিশু অবস্থার মতো।
৩. মেডুসা (Medusa): পূর্ণবয়স্ক জেলিফিশের রূপ। এটি হলো ভেসে বেড়ানো, স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ।

Turritopsis dohrnii-এর বিশেষত্ব এখানেই, এই প্রাণীটি যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, বা পরিবেশগত চাপ অনুভব করে, তখন এটি সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটে। অর্থাৎ, এটি নিজের পূর্ণবয়স্ক অবস্থাকে ধ্বংস করে আবার পলিপ অবস্থায় ফিরে যায়।

এমনকি বারবারও এটি করতে পারে, যেন নিজের জীবনকে প্রতিবার নতুন করে “রিসেট” করে নেয়!

একটি জেলিফিশ, হাজারটি জীবন

এই জেলিফিশটির শরীরে ঘটে এক জটিল প্রক্রিয়া যার নাম “ট্রান্সডিফারেনশিয়েশন”। এটি এমন এক ক্ষমতা, যেখানে একটি কোষ নিজেকে অন্য ধরনের কোষে রূপান্তর করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পেশির কোষ আবার ত্বকের কোষ হয়ে যেতে পারে। এমন ক্ষমতা মানবদেহে নেই, কিন্তু এই ক্ষুদ্র জেলিফিশ দিব্যি এই কাজটি করে চলেছে।

বয়স বাড়লে, আহত হলে, বা পরিবেশ প্রতিকূল হলে, Turritopsis dohrnii নিজের সমস্ত কোষকে রূপান্তর করে আবার শিশু অবস্থায় ফিরে যায়। আর এইভাবে সে যেন মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে।

তাহলে কি এই প্রাণী সত্যিই ‘অমর’?

আসুন পরিষ্কার করে নিই, Turritopsis dohrnii কখনোই বার্ধক্যে মারা যায় না। কিন্তু এটি পূর্ণ অমর নয়, কারণ এটি মারা যেতে পারে অন্য কারণে, যেমন শিকারির আক্রমণে, রোগে, দূষণে বা দুর্ঘটনায়। তবে এদের শরীরে বয়সজনিত মৃত্যু হয় না, এবং সেটাই একে পৃথিবীর একমাত্র “বায়োলজিক্যালি ইমমর্টাল” প্রাণীতে পরিণত করেছে।

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি এই জেলিফিশে কেন?

এই জেলিফিশ আমাদের সামনে এমন এক দ্বার খুলে দিয়েছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বার্ধক্য রোধ, কোষ থেরাপি, এমনকি ক্যানসার চিকিৎসাতেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই প্রাণীর জীবনচক্র বিশ্লেষণ করে মানুষ হয়তো একদিন নিজেদের শরীরেও কোষ পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া চালু করতে পারবে।

একটি উদাহরণ কল্পনা করুন...

ধরুন আপনার ৭৫ বছর বয়স হয়েছে। আপনি ক্লান্ত, অসুস্থ। হঠাৎ আপনার শরীর ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করল। বয়স কমে গিয়ে আপনি আবার ১০ বছর বয়সের এক শিশু হয়ে গেলেন। আবার নতুন জীবন, আবার বেড়ে ওঠা।

এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কি আপনি চাইবেন চিরকাল এমনভাবে বেঁচে থাকতে? ঠিক এই কাজটাই করে Turritopsis dohrnii।

শেষ কথা

Turritopsis dohrnii আমাদের শেখায়, প্রকৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন সব রহস্য, যা আমরা এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারিনি। এই ক্ষুদ্র অথচ বিস্ময়কর জেলিফিশ দেখিয়ে দেয়, প্রকৃতি কখনো কখনো সিনেমার চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর!

কী ভাবছেন? অমরতা কি আশীর্বাদ, না অভিশাপ? যদি সুযোগ পান, আপনি কি চিরকাল বেঁচে থাকতে চাইবেন? মতামত জানান কমেন্টে!

এমন আরও অদ্ভুত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও রহস্যময় গল্প পেতে চোখ রাখুন: বিচিত্রলোক ডট কম (bichitrolok.com) এ!

Comments