এই সেই প্রাণী, যার নীল রক্ত সোনার চেয়েও বেশি মূল্যবান!

বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে ওষুধের কোম্পানিগুলো এই প্রাণীর রক্তের পেছনে পাগল হয়ে আছে। চলুন জেনে নিই এই আশ্চর্য প্রাণী এবং এর রক্তকে ঘিরে রহস্যময় কিছু তথ্য।

এই রহস্যময় প্রাণীটি কে?

এই অমূল্য রক্তধারী প্রাণীটি হলো হর্সশু ক্র্যাব (Horseshoe Crab) বা ঘোড়াশুঁটি কাঁকড়া। মেক্সিকো উপসাগর এবং উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলে এই প্রাণী দেখা যায়। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Limulus Polyphemus।

এই প্রাণীর সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো, এর রক্তের রঙ নীল! আর সেই নীল রক্তই আজ কোটি কোটি টাকার বাজার তৈরি করেছে।

এই রক্তের দাম কেন এত বেশি?

হর্সশু ক্র্যাবের রক্তে আছে Limulus Amebocyte Lysate (LAL) নামের এক বিশেষ উপাদান, যা ব্যাকটেরিয়া বা বিষাক্ত টক্সিন শনাক্ত করতে পারে মুহূর্তের মধ্যে।

এই উপাদানটি ব্যবহার হয় - টিকা (vaccine) তৈরি করার সময়, ইনজেকশন বা ইনফিউশন নির্ভর ওষুধ পরীক্ষায়, সার্জারি বা চিকিৎসার আগে যন্ত্রপাতির স্টেরিলিটি যাচাইয়ে, অর্থাৎ, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এই রক্তের জুড়ি মেলা ভার!

এই কারণেই এক লিটার হর্সশু ক্র্যাবের রক্তের দাম দাঁড়ায় প্রায় ১৫ হাজার ডলার বা ১৩ লক্ষ টাকার কাছাকাছি!

এদের শিকার (এক অজানা বিপদ)

এই অমূল্য রক্তের জন্য হর্সশু ক্র্যাবদের ধরা হচ্ছে বিপুল হারে। যদিও রক্ত সংগ্রহের পরে আবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়, তবুও এই প্রক্রিয়ায় বহু প্রাণী মারা যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ধীরে ধীরে এই প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

হর্সশু ক্র্যাব সম্পর্কে আরও কিছু মজার ও বিস্ময়কর তথ্য

১. ডাইনোসরেরও আগে জন্ম!

হর্সশু ক্র্যাব পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ৪৫ কোটি বছর আগে, যা ডাইনোসরেরও আগে!

২. নীল রক্ত কেন?

মানুষের রক্তে আয়রন থাকে বলে তা লাল, কিন্তু হর্সশু ক্র্যাবের রক্তে থাকে তামা (Copper), তাই তা নীল রঙের।

৩. চোখের সংখ্যা ১০টি!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন! হর্সশু ক্র্যাবের দুইটি প্রধান চোখ আছে মাথার উপরে, কিন্তু পুরো শরীরে ছড়িয়ে আছে আরও আটটি অতিরিক্ত চোখ, যা আলোর তীব্রতা ও চলাচল শনাক্ত করতে পারে।

৪. জল ও মাটি, দুটোতেই থাকতে পারে!

হর্সশু ক্র্যাব মূলত সামুদ্রিক প্রাণী হলেও এরা কিছুটা সময় মাটিতেও কাটাতে পারে। ডিম পাড়ার সময় এরা বালিতে উঠে আসে।

৫. দাঁত নেই!

হর্সশু ক্র্যাবের কোনো দাঁত নেই। এরা পায়ের মাধ্যমে খাবারকে চূর্ণ করে তারপর খায়!

৬. উল্টা অবস্থায় থাকলে, নিজেই নিজেকে সোজা করে নিতে পারে!

জলে বা বালিতে যদি হর্সশু ক্র্যাব উল্টে যায়, তাহলে এরা নিজের লেজ ব্যবহার করে নিজেকে সোজা করে নিতে পারে।

৭. জীবনকাল অনেক দীর্ঘ!

একটি হর্সশু ক্র্যাব গড়ে ২০-৪০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে! এবং যৌবনে পৌঁছাতে সময় নেয় প্রায় ১০ বছর।

৮. সন্তানসংখ্যা লাখে!

একটি স্ত্রী হর্সশু ক্র্যাব একসাথে প্রায় ৯০,০০০ ডিম পাড়ে। তবে এর বেশিরভাগই শিকারি পাখি বা মাছের খাদ্য হয়ে যায়।

৯. মহাকাশ গবেষণাতেও এদের অবদান!

এদের চোখ ও দৃষ্টিশক্তি নিয়ে গবেষণা হয়েছে নাসার স্পেস প্রজেক্টে, কারণ এদের চোখের গঠন বিশেষভাবে আলো শনাক্ত করতে সক্ষম।

শেষ কথা

ঘোড়াশুঁটি কাঁকড়া তাদের নীল রক্তের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়ার এন্ডোটক্সিন শনাক্তকরণে। তবে, অতিরিক্ত আহরণ এবং আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, যা সমগ্র উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই প্রজাতির সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প পরীক্ষার পদ্ধতি অনুসন্ধান, এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা করা জরুরি। এতে করে আমরা এই প্রাচীন প্রাণীগুলির অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারব এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হব।

Comments